

পৃথিবীতে সবথেকে বড় প্রতিশোধের নাম ‘ক্ষমা’। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকাল আমরা ক্ষমা করতেই ভুলে গেছি। ক্ষমা শব্দটি বাংলা। যার আরবি প্রতিশব্দ ‘আফউন’। ইসলামী পরিভাষায় অন্যায়-অত্যাচার ও উৎপীড়নের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও করুণা দেখিয়ে অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া, তার প্রতি সহনশীলতা ও উদারতা প্রদর্শন করাকে ক্ষমা বলা হয়। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি।
খেলাফতের দায়িত্ব পালনে যে সব সিফাত বা গুণ অর্জন করা প্রয়োজন তার মধ্যে ক্ষমা অন্যতম। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি সর্বদা বান্দার অপরাধ ক্ষমা করে থাকেন বলে তাকে গফুর ও গাফফার নামে অভিহিত করা হয়। যদি আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা না করতেন, তাহলে দুনিয়াতে কোনো বান্দাই রক্ষা পেত না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমার গুণে গুণান্বিত হয়ে অপর বান্দার অপরাধ ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে খুব ভালোবাসেন।
কেউ আঘাত করলে তাকে প্রতিঘাত করতেই হবে এ-যেনো চিরন্তন সত্য অথচ একমাত্র ক্ষমায় পারে শান্তি আর পরিবর্তন আনতে। ক্ষমা করার পর কি পরিমাণ আনন্দ অনুভব হয় তা বুঝতে হলে একবার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পাওয়ার পরে বিনা শর্তে ক্ষমা করে দিন। এতে যে আপনার হৃদয় শীতল হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সবচাইতে আনন্দের কথা হচ্ছে ক্ষমা মানুষের মান-মর্যাদা বাড়ায়। কাউকে ক্ষমা করে একজন সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠতে পারেন অসাধারণ মানুষ। ক্ষমাশীল মানুষ সর্বোত্তম ব্যবহারকারী ও ধৈর্যশীল। যিনি উদারপ্রকৃতির, তিনিই ক্ষমাশীল। যাদের এ ধরনের গুণাগুণ রয়েছে, তারা আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামতপ্রাপ্ত। ক্ষমাকারী ধৈর্যবান ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।
জন্মভূমি মক্কা হতে বিতাড়িত হওয়ার ৭ বছর ৩ মাস ২৭ দিন পর বিজয়ী বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিরদূত, নবীকুল শিরোমণি, শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তার নিকটে আত্মসমর্পণ করেন। এতদিন যারা রাসুল (সা.) ও তার অনুসারিদের শত কষ্ট দিয়েছেন, অত্যাচার করেছেন আজ হাতের কাছে পেয়েও তিনি তাদের থেকে কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপর আমার কোন অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’।
রাসূলের (সা.) এ ভাষণ শুনে আর তার আচরণ দেখে সমবেত সবাই ঘোষণা করলেন, সত্যি আপনি আল্লাহর নবী; আপনি কোন দেশ বিজয়ী সাধারণ বীর যোদ্ধা বা বাদশা নন।
মক্কা বিজয়ের পর পরাজিত শত্রুর প্রতি মোহাম্মদ (সা.)-এর আচরণ ও তার ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ও নজিরবিহীন ঘটনা। যা আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় মানবিক সমাজ গঠনে এবং ভ্রাতৃত্ব পুনঃস্থাপণ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক অনুপম, অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
পদ-পদবি কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় অধীনস্থদের উপর অন্যায় ভাবে কোন কিছু ছাপিয়ে দেওয়াটাও অপরাধ। অন্যায়ভাবে ছাপিয়ে দেওয়ার ফলে অধীনস্থ কর্মকর্তা সে সময় প্রতিবাদ করতে না পারলেও সে মনে মনে কষ্ট পান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আচরণে যা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করবে না।
কিছু ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় আপনি সরল মনে ক্ষমা করলেন কিন্ত সেই ব্যক্তি আপনার ক্ষমাকে দূর্বলতা মনে করবে এবং ভিন্নভাবে এই সংবাদ আপনার কাছে পৌঁছাবে তখন হয়তোবা সেই সংবাদ আপনার মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে। তারপরও ক্ষমা করে দিন, কারণ মহান আল্লাহ তার বান্দারা বারবার ভুল করার পরও ক্ষমা করার শিক্ষাই দিয়েছেন।
ক্ষমা ক্ষমতাকে মজবুত করে, মানসিক মনোবল দৃঢ় করে এবং এই শক্তিশালী মনোবল একজন ব্যক্তিকে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে নিঃসন্দেহে।
মানুষ মাত্রই ভুল, আমরা কেউ ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নই। যে কোনো কাজেই ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই সব সময় ভুল-ত্রুটি জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই উত্তম। মহান আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে ধাবমান হও; যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ন্যায়। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকি তথা আল্লাহ ভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা রাগ সংবরণকারী আর মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ নেককারদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৩৩-১৩৪)
আবার ক্ষমা চাওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি ভুল সে সঠিক। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ এই যে, আপনি আপনাদের সম্পর্কটিকে আপনার আত্মসম্মান বোধ আর অহংকারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেন এবং সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য অপরের ভুলকে নিজের মনে করে ক্ষমা চাইলেন এতে অনেক ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এককথায় ছোট-বড় সবাইকে ক্ষমা করতে পারলেই আপনি আমি মানুষ, অন্যথায় আমরা মানুষরূপী জনসংখ্যা ছাড়া আর কিছুর তালিকায় স্থান পাবো বলে আমার মনে হয় না। তাই আসুন ক্ষমার মহিমান্বিত আদর্শ হৃদয়ে লালন করি, ধারণ করি, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল আচরণ করে ভ্রাতৃত্ব পূর্ন সমাজ গঠনে শামিল হই।