

শিয়াল আমাদের লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন ও গল্পে বুদ্ধিমান এবং ধূর্ত প্রাণী হিসেবে স্থান পেয়েছে। গ্রামবাংলায় রাত নামলেই শিয়ালের ডাক শোনা যায়—এ যেন প্রকৃতিরই এক স্বাভাবিক সুর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় শিয়ালের ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে। পাহাড় থেকে লোকালয়ে নেমে এসে শিয়াল মানুষের ওপর আক্রমণ করছে, এমনকি গবাদি পশুও এর শিকার হচ্ছে।
প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের ফলাফল:
বন্যপ্রাণী কখনো অকারণে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। প্রকৃতির ভেতরেই তাদের খাবার, নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার স্বাভাবিক ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু যখন বন-জঙ্গল ও পাহাড় নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়, তখন প্রাণীরা আশ্রয় হারায়। চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র দেয়াং পাহাড় আজ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের বুক চিরে কারখানা গড়ে ওঠায় বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক আবাস ধ্বংস হচ্ছে। ফলে শিয়ালসহ অন্যান্য প্রাণী খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে এবং ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষকেও আক্রমণ করছে।
শাস্তি নাকি সমাধান?
আইন অনুযায়ী বন্যপ্রাণী হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আতঙ্কে গ্রামবাসী যখন শিয়াল মেরে ফেলে, তখন তারা আসলে আইন ভাঙার জন্য নয়—নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই এমন কাজ করে। তাই শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রথমে বুঝতে হবে, শিয়াল কেন লোকালয়ে আসছে।
স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি:
ঘটনার আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো চিকিৎসা ব্যবস্থা। আনোয়ারা ও কর্ণফুলী—কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই শিয়াল বা কুকুরের কামড়ের টিকা নেই। কামড়ের শিকার মানুষদের ভরসা করতে হচ্ছে চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি জরুরি টিকার ব্যবস্থা থাকত, তবে আতঙ্ক অনেকটাই কমানো যেত।
করণীয়:
১. পাহাড় ও বন রক্ষা: শিল্পায়ন হোক পরিকল্পিত, প্রকৃতিকে হত্যা করে নয়।
২. বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়: পাহাড়ে খাদ্য ও প্রজননের সুযোগ ফিরিয়ে দিতে হবে।
৩. জনসচেতনতা: শিয়ালের কামড়ের ঝুঁকি, প্রতিকার ও টিকা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবা জোরদার: প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কামড় প্রতিরোধক টিকা মজুত রাখতে হবে।
শিয়াল যাবে সেই পথেই, যেখানে তার খাবার, নিরাপত্তা ও টিকে থাকার নিশ্চয়তা থাকবে। মানুষ যদি প্রকৃতির পথ রুদ্ধ করে, তবে বন্যপ্রাণীও বাধ্য হয়ে লোকালয়ের পথ বেছে নেবে। তাই প্রশ্নের উত্তর একটাই—প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।