

ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় শুরু হয়েছে মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। গত ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা চলবে আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২৫’ শীর্ষক বিশেষ এই কর্মসূচি শুরু করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। আশ্বিনী পূর্ণিমার আগের ৪ দিন এবং অমাবস্যার পরের ৩ দিন অন্তর্ভুক্ত করে মোট ২২ দিন এই অভিযান চলবে। এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে উপকূলীয় ইলিশ প্রজননক্ষেত্রের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মা ইলিশকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে এবং ইলিশের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ এর অধীনে প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫-এর রুল ১৩ অনুযায়ী, সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ সময় নিয়মিত চলবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা।
নিষেধাজ্ঞার এই ২২ দিন দেশের অভ্যন্তরীণ সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকা এবং নদ-নদীতে মা-ইলিশ রক্ষায় সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি কাজ করেবে নৌবাহিনীর জাহাজ। গত দুই বছরের মতো এবছরও এসব জাহাজ অভিযানের অংশ হিসেবে সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া অঞ্চলে বিশেষ টহল দেবে এসব জাহাজ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে-পরে মিলিয়ে মোট ১৫ থেকে ১৭ দিন ইলিশের ডিম ছাড়ার প্রধান মৌসুম মনে করা হলেও এখন সময় আরও বাড়িয়েছে সরকার।
গবেষকদের মতে, ইলিশ শুধু আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় নয়, অমাবশ্যায়ও ডিম ছাড়ে। তাই সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে ২২ দিন করা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, এ সময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ ছুটে আসে নদীতে। ফলে মা-ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন রাখতে প্রতিবছর তিন সপ্তাহ ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার।
সুত্র জানিয়েছে, গত ১২ বছরে দেশে ইলিশ আহরণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০০৮-০৯ সালে দেশের ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহোরিত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছর এর পরিমাণ ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
তবে মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কিছু সংখ্যক দুর্বৃত্ত রাতের অন্ধকারে দেশের মেঘনাসহ বিভিন্ন এলাকার নদীতে ইলিশ শিকার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। দিনে নদীতে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করা গেলেও রাতে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নদীতে যান না। এই সুযোগেই শত শত জেলে রাতের অন্ধকারে ইলিশ শিকারে নদীতে নামেন নৌকা বা ট্রলার নিয়ে।
স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার কোথাও কোথাও তাদের ‘ম্যানেজ করে’ নদীতে ইলিশ ধরার মহোৎসব চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুন্সিগঞ্জের পর ধলেশ্বরী থেকে শুরু করে পুরো মেঘনা নদী হয়ে মুলাদি এবং শিকারপুরের সন্ধ্যা নদীর মোহনা পর্যন্ত অপরদিকে ভোলার তেতুলিয়া নদীতে রাতে চলে ইলিশ আহরণ। এসব নদীতে রাতের বেলায় চলাচলকারী একাধিক নৌযানের চালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহম্মদ আশরাফুল আলম খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মা ইলিশ রক্ষায় যা করণীয় জেলা প্রশাসন তাই করবে।
ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, ইলিশ সম্পদ রক্ষায় প্রতিবছরের মতো এ বছরও আইন অনুযায়ী শুরু থেকেই নদীতে দিনে এবং রাতে নৌ পুলিশের পাশাপাশি আনসার কোস্টগার্ড নিয়মিত টহল দেবে। কোনও দুর্বৃত্ত নদীতে ইলিশ মাছ ধরার চেষ্টা করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ২০২৫ সালের মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান আগের বছরের তুলনায় আরও সংগঠিত ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হবে।’
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এবারের অভিযান চলাকালে দেশের ইলিশ অধ্যুষিত ৩৭টি জেলার ১৬৫টি উপজেলার তালিকাভুক্ত ৬ লাখ ২০ হাজার ১৪০ জেলে পরিবারকে ভিজিএফ (চাল) দেওয়া হবে। পরিবার প্রতি বরাদ্দ থাকবে ২৫ কেজি করে চাল। এ অভিযানের সময় নির্ধারিত জলসীমার মাছ ধরা ট্রলারের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। নদীতে এই সময় ড্রেজিং সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা হবে।
মৎস্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গতবছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের অভিযানে ২ হাজার ১৬৯টি মোবাইল কোর্ট ও ৯ হাজার ৮১৩টি অভিযানের মাধ্যমে ৫৪ দশমিক ৮৬ মেট্রিক টন ইলিশ জব্দ, ৬১২ দশমিক ১১ লাখ মিটার জাল ধ্বংস এবং ৭৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিরোজপুরের পাড়ের হাটের ইলিশ ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার মৌসুমে আমরা অনেকটাই অলস সময় কাটাই। তবে অনেকেই এ সময় ক্ষতিগ্রস্থ নৌকা ও জাল মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তালিকায় নাম না থাকায় সরকারিভাবে দেওয়া ভিজিএফ’র চাল সুবিধা অনেকেই পায় না। যারা পায় না তারা অনেক কষ্ট করেন এ সময়।’